জমি হস্তান্তর

জমি হস্তান্তর – বিক্রয়

জমি হস্তান্তর 

জমির মালিকানা কার– এই তথ্য খুঁজে বের করা বেশ কঠিন কাজ। কারণ দিন দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে পাশাপাশি একজন অন্য জনের জমি দখলের ঘটনাও দিন দিন বাড়ছে। আবার অনেকেই জানে না যে তাদের কোথায় জমি আছে। এই সকল কারনে একই জমি একাধিক মালিকের নামে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। সুতরাং, জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সময় জমিটি কার নামে আছে এবং সে জমিটির মালিক কীভাবে হয়েছে তা দেখে নেওয়া খুবই জরুরি। আইনিসেবা পূর্ববর্তী মালিক সঠিকভাবে বা আইনিভাবে জমি/সম্পত্তির মালিকানা লাভ করেছে কিনা – তা অনুসন্ধানে সকল প্রকার সহায়তা করে থাকে।

নিন্মোক্ত দলিল সঠিকভাবে সম্পাদনের মাধ্যমে জমি হস্তান্তর বা সম্পত্তির মালিকানা পরিবর্তন করা যায়:
১. হেবা
২. বিক্রয়
৩. ওয়াকফ
৪. উত্তরাধিকার
৫. উইল/ অছিয়ত
৬. নামজারি
৭. পাওয়ার অব অ্যাটর্নি

জমি হস্তান্তর – জমি ক্রয়ের পূর্বে ও পরে করণীয়

জমি ক্রয়কালে বা জমি হস্তান্তর এর জন্য ক্রেতাদেরকে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে তা তুলে ধরা হলো:

১। জরিপের মাধ্যমে প্রণীত রেকর্ড অর্থাৎ খতিয়ান ও নকশা যাচাই করতে হবে।

২। জমির তফসিল অর্থাৎ জমির মৌজা, খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর উক্ত দাগে জমির মোট পরিমাণ জানতে হবে।

৩। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সিএস, এসএ, আরএস, বিএস পর্চা দেখতে হবে।

৪। বিক্রেতা ক্রয়সূত্রে ভূমির মালিক হয়ে থাকলে তার ক্রয় দলিল বা ভায়া দলিল রেকর্ডের সঙ্গে মিল করে বিক্রেতার মালিকানা নিশ্চিত হতে হবে।

৫। বিক্রেতা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হলে সর্বশেষ জরিপের খতিয়ান বিক্রেতা বা তিনি যার মাধ্যমে প্রাপ্ত তার নামে অস্তিত্ব (যোগসূত্র) মিলিয়ে দেখতে হবে।

৬। জরিপ চলমান এলাকায় বিক্রেতার কাছে রক্ষিত মাঠ পর্চা যাচাই করে দেখতে হবে।

৭। বিক্রেতার কাছ থেকে সংগৃহীত দলিল সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিস/জেলা রেজিস্ট্রার রেকর্ড রুম হতে যাচাই করে দেখতে হবে।

৮। খতিয়ান/পর্চা/মৌজা ম্যাপ ইত্যাদি কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি অফিস/উপজেলা ভূমি অফিস/জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুম হতে যাচাই করে দেখতে হবে।

৯। হাল সন পর্যন্ত ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) পরিশোধ আছে কি না দেখতে হবে।

১০। প্রস্তাবিত সম্পত্তির দখল বিক্রেতার আছে কি না। সম্পত্তিতে বিক্রেতার দখল না থাকলে সে জমি ক্রয় করা উচিত হবে না।

১১। ওয়ারিশি জমি কিনতে চাইলে, ঐ সম্পত্তিতে মোট কতজন ওয়ারিশ আছে তা খোজ নিয়ে দেখুন। আপনি যে ওয়ারিশের নিকট থেকে কিনবেন, তার ততটুকু বিক্রয়ের অধিকার আছে কিনা যাচাই করুন।

১২। সম্পত্তিটি খাস কিংবা সরকারী কিনা যাচাই করুন। সরকারী বা খাস সম্পত্তি বিধিবহির্ভূত ভাবে ক্রয়-বিক্রয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

১৩। অন্য কোন পক্ষের সাথে বিক্রয় চুক্তি বা বায়না পত্র রেজিস্ট্রি করা আছে কি না তা যাচাই করুন।

১৪। ব্যাংক বা কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিকট দায়বদ্ধ কি না তা যাচাই করুন।

১৫। জমি বিক্রয়ের জন্য অ্যাটর্নি নিয়োগ করা আছে কিনা তা যাচাই করুন। অ্যাটর্নি নিয়োগ করা থাকলে অ্যাটর্নি ছাড়া মূল মালিকের সম্পাদন গ্রহণযোগ্য নয়।

১৬। জমি নিয়ে মামলা মোকদ্দমা চলছে কিনা যাচাই করুন। মামলাভুক্ত জমি কেনা উচিত নয়।

জমি হস্তান্তর

জমি হস্তান্তর – বিক্রয়

জমি হস্তান্তর – জমি ক্রয়ের পরে ক্রেতা বা মালিকের করণীয়:

১। জমি রেজিস্ট্রি করার পর ক্রয়কৃত জমির দখল, সীমানা নির্ধারণ এবং জমি ব্যবহার তথা চাষাবাদ বা বাড়ীঘর নির্মাণ করা।

২। রেজিস্ট্রি অফিস হতে মূল দলিল গ্রহন করা। মূল দলিল প্রাপ্তিতে বিলম্ব হলে দলিলের সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করা।

৩। মিউটেশন / নামজারি করার জন্য সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর অফিসে দলিলের সত্যায়িত কপিসহ নির্ধারিত ফরমে আবেদন করে মিউটেশন/নামজারি করানোর ব্যবস্থা করা।

৪। নিয়মিত ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা, ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ না করা হলে জমি নিলাম হয়ে যেতে পারে।

৫। ভালোভাবে জমির সীমানা চিহ্নিত করে না রাখলে অন্যেরা অনধিকার প্রবেশ করার সুযোগ পাবে।

বাংলাদেশের প্রায় ৭০% লোক কোন না কোনভাবে ভূমির উপর নির্ভরশীল। এদেশে ভূমি একটি বেশ সংবেদনশীল ও স্থিতিশীল সেক্টর। বিভিন্ন কারণে ভূমি বিরোধ সৃষ্টি হয়, প্রধান কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

(ক) যৌথ পরিবারের মধ্যে ভাগবণ্টন সংক্রান্তে বিরোধ;

(খ) ক্রয়কৃত জমির প্রকৃত মালিকানা সংক্রান্তে জটিলতা;

(গ) ক্রয়কৃত জমির দলিল সঠিকভাবে রেজিষ্ট্রি না করা;

(ঘ) ভূমি অফিসের রেকর্ড সংগ্রহে জটিলতা/ত্রুটি;

(ঙ) পৈত্রিক সম্পত্তি বন্টনে স্বচ্ছতার অভাব;

(চ) যৌথ পরিবারে বিশেষভাবে মেয়ে সন্তানদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির যথাযথবণ্টন না করা ইত্যাদি। 

জমি হস্তান্তর – বিদেশে থেকে কি জমি ক্রয় করা যায়? 

বিদেশে থেকে জমি কেনার কোন উপায় এখন আর নেই। ২০০৫ সালের ১ জুলাই থেকে জমির যেকোনো হস্তান্তরযোগ্য দলিল রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে বিক্রেতার পাশাপাশি ক্রেতাকেও দলিল করার সময় উপস্থিত থাকতে হবে। তাই বিদেশে বসে কিংবা অপ্রাপ্ত-বয়ষ্ক ছেলে মেয়ের নামে জমি কেনা এখন আর সম্ভব হয় না। 

জমি হস্তান্তর – বিদেশ থেকে জমি বিক্রয় করা যায় কি?

বিদেশ থেকে যে কেউ তার দেশে রেখে যাওয়া যেকোনো সম্পত্তি বিক্রয় করতে পারবেন। এই বিক্রয় করতে হলে তাকে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিতে হবে। শুধু জমিজমা-সংক্রান্ত নয়, যেকোনো কাজ আপনার অনুপস্থিতিতে সম্পাদনের ক্ষমতা অর্পণ করতে পারেন।

জমি হস্তান্তর – প্রতারণামূলক ভাবে একই জমি একাধিক হস্তান্তরে আইনি প্রতিকার

প্রতারণামূলকভাবে একই জমি একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করলে উক্ত জমিতে কে অগ্রাধিকার পাবে সম্পত্তি হস্তান্তর আইন-১৮৮২ এর ৪৮ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে। এ ধারায় হস্তান্তর বা সম্পত্তি বিক্রি দ্বারা সৃষ্ট অধিকারের অগ্রাধিকার নীতির অর্থ হলো- সময়ের দিক হতে যিনি প্রথম হবেন, আইনের দিক হতে তিনি অধিকার লাভ করবেন। কোন সম্পত্তির আইনসঙ্গত মালিক যদি একই সম্পত্তি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করেন তাহলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা নিরসন করার জন্য এই ধারায় বিধান রাখা হয়েছে। যিনি প্রথম হস্তান্তর গ্রহণ করবেন তিনি সম্পত্তিটি পাবেন। তবে প্রথম হস্তান্তর আইনানুগ বৈধ না হলে সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৪৮ ধারা অনুসারে পরবর্তী হস্তান্তরের ওপর তা প্রাধান্য পাবে না। 

কারণ এই নীতির অর্থ হলো- সময়ের দিক হতে যিনি প্রথম হবেন আইনের দিক থেকে তিনি সুবিধা পাবেন। জমি বিক্রেতা একবার বিক্রয়ের মাধ্যমে ওই জমির সব অধিকার হারায়।

অগ্রাধিকার নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। যেমন- 

১. একই সম্পত্তির ওপর হস্তান্তরের মাধ্যমে অধিকারসমূহ সৃষ্টি করতে হবে; 

২. হস্তান্তরগুলো ভিন্ন ভিন্ন তারিখে হতে হবে।

৩. একই সঙ্গে একই দলিলে হলে চলবে না; 

৪. হস্তান্তর আইনগতভাবে বৈধ ও পরিপূর্ণ হতে হবে;

৫. হস্তান্তরগুলো পরস্পরের সাথে সংঘাতময় হতে হবে; 

৬. বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশন করা না হলে তা পরবর্তী রেজিস্ট্রেশন দলিলের ওপর প্রাধান্য পাবে না, বিশেষ করে ২০০৫ সালের ১ জুলাই থেকে জমির যেকোনো হস্তান্তরযোগ্য দলিল রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে; 

৭. বিপরীত মর্মে কোন চুক্তি থাকলে অগ্রাধিকারের বিধান কার্যকর নয়; 

৮. হস্তান্তরিত সম্পত্তিটি স্থাবর সম্পত্তি হবে।

ফৌজদারি আইনে প্রতিকার: কেউ যদি জমি কিনে এই ধরনের প্রতারণার শিকার হন তাহলে সে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে প্রতারণার অভিযোগে মামলা দায়ের করতে পারে।

 

জমি হস্তান্তর এর একটি হলো হেবা বা দান 

মালিকানার অতিরিক্ত জমি বিক্রি কিংবা লিখে নিলে: জমি হস্তান্তর

কোনো ব্যক্তি মালিকানার চেয়ে অতিরিক্ত জমি বিক্রির জন্য দলিল সম্পন্ন করলে এবং গ্রহীতা হিসেবে অতিরিক্ত জমি লিখে নিলে সর্বোচ্চ ৫ বছরের জেল বা ১০ লাখ টাকা বা উভয় দণ্ডিত হবেন। এমন বিধান রেখে ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২২’-এর খসড়া করেছে সরকার। শনিবার (২২ জানুয়ারি) খসড়াটি মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়।

এছাড়া একই অপরাধ আবার করার ক্ষেত্রে দ্বিগুণ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। এছাড়া বেশ কয়েক শ্রেণির অপরাধকে অজামিনযোগ্য হিসেবে প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া খসড়ায় জমির পরিমাণ ও অপরাধীর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বর্ধিত সাজারও বিধান রাখা হয়েছে।

খসড়ায় বলা হয়, যদি কোনো ব্যক্তি লাভবান হতে ব্যক্তি মালিকানাধীন বা সরকারি খাসভূমিসহ সরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার মালিকানাধীন জমি নিজের নামে রেজিস্ট্রিকরণসহ এর মালিকানা সংক্রান্ত যেকোনো জাল দলিল তৈরি করেন, তাহলে তিনি সর্বোচ্চ দুই বছরের তবে কমপক্ষে ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। 

কোনো ব্যক্তি ভূমি হস্তান্তর দলিল সম্পাদনকালে দাতা হিসেবে লাভবান হতে কোনো জমিতে মালিকানা ও দখল না থাকা সত্ত্বেও নিজেকে ওই জমির মালিক হিসেবে উপস্থাপন করে জাল দলিল সম্পাদন করেন বা তার মালিকানা ও দখলীয় জমির অতিরিক্ত জমি দলিলে লিপিবদ্ধ করেন, তবে তিনি ২ থেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই অপরাধকে জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে খসড়া আইনে।

এছাড়া যদি কোনো ব্যক্তি ভূমি হস্তান্তর দলিল সম্পাদনকালে গ্রহীতা হিসাবে লাভবান হতে কোনো জমিতে দাতার মালিকানা ও দখল না থাকার কথা জানা সত্ত্বেও দাতার মাধ্যমে তার মালিকানা ও দখলীয় জমির অতিরিক্ত জমি দলিলে লিপিবদ্ধ করান, তবে তাকে ২ থেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড পেতে হবে। এই অপরাধকেও জামিন অযোগ্য রাখা হয়েছে।

জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধ সমূহ দেওয়ানী আদালতে নিস্পত্তিযোগ্য। দেওয়ানী আদালতে বিচার কার্য্য সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয় যার ফলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিবর্গ নিজেরা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জমির দখল নিতে সচেষ্ট হন। ফলশ্রুতিতে জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে এলাকায় দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ শান্তি ভঙ্গের আশংকা দেখা দেয়। দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রায় ৬০% ফৌজদারী মামলা ভূমি সংক্রান্ত ঘটনা বা ঘটনার জের হিসাবে হয়ে থাকে। সুতরাং জমির ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সকলের অধিক যত্ববান ও সর্তক হওয়া উচিত।

এ বিষয়ে আরো জানতে যোগযোগ করুন আমাদের হটলাইন নাম্বারে। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *