ট্রেড লাইসেন্স Trade license

ট্রেড লাইসেন্স তৈরী ও নবায়ন করার পদ্ধতি ২০২২

ট্রেড লাইসেন্স তৈরী ও নবায়ন করার পদ্ধতি ২০২২ : প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, খরচ ও সময়

Trade অর্থ ব্যবসা এবং License অর্থ অনুমতি; অর্থাৎ, ব্যবসা করার জন্য যে অনুমতি, পত্রের মাধ্যমে দেওয়া হয়, তাকে Trade License Paper বলা হয়। বাংলাদেশে বৈধভাবে যেকোনো ব্যবসা পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স করা বাধ্যতামূলক। ব্যবসা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহারযোগ্য নয়। এছাড়া, ব্যাংক ঋণ নিতে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব খুলতে, ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে ব্যবসায়ীর বিদেশে যাওয়াসহ বিভিন্ন কাজে ট্রেড লাইসেন্স অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ট্রেড লাইসেন্স বাংলাদেশ সরকার সিটি কর্পোরেশন কর বিধান – ১৯৮৩ (City Corporation Taxation Rules, 1983) এর অধিনে ইস্যু করে থাকে ।  

সিটি কর্পোরেশন [কর] বিধি, ২০০৯ এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ট্রেড লাইসেন্সের সূচনা ঘটে। এই লাইসেন্স উদ্যোক্তাদের আবেদনের ভিত্তিতে প্রদান করা হয়। সিটি কর্পোরেশন বা সিটি পরিষদ এই প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করে থাকে। ট্রেড লাইসেন্স বিশেষভাবে শুধুমাত্র লাইসেন্সধারী ব্যক্তির নামে প্রদান করা হয় এবং এটা কোনোভাবে হস্তান্তরযোগ্য নয়। এই লাইসেন্স ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারবে না। প্রতিটি ব্যবসার জন্য ভিন্ন ভিন্ন লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। নবায়নকৃত ট্রেড লাইসেন্স আঞ্চলিক কর অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদান করে থাকেন। ট্রেড লাইসেন্সের জন্য নির্ধারিত ফি লাইসেন্স ফরমে উল্লেখিত যে কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে জমা দিতে হবে।

কোথায় যেতে হয়

ট্রেড লাইসেন্স ব্যবসায়ীকে দেশের যেকোনো স্থানে তার ব্যবসাটি পরিচালনা করার স্বাধীনতা দেয়। ব্যবসায়ের অনুকূলে যেকোনো কার্যক্রমের জন্য ট্রেড লাইসেন্স একটি অবধারিত নথি। 

ট্রেড লাইসেন্স করার জন্য আবেদনকারীকে প্রথমেই ঠিক করতে হবে যে তার ব্যবসাটি আসলে কোন স্থানীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হবে। স্থানীয় সরকার বলতে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা বা উপজেলা পরিষদকে বোঝায়। একটি অফিসের নিমিত্তে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে দেশব্যাপী ব্যবসা করা যায়। তবে ব্যবসা প্রসারের স্বার্থে অন্য স্থানীয় সরকারের অধীনে শাখা অফিস করতে হলে সেখানকার জন্য পৃথক ট্রেড লাইসেন্স করতে হবে।  ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে কোন অঞ্চল ভিত্তিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালিত হবে তা নির্বাচন করতে হবে। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রত্যেকটিতে অঞ্চল রয়েছে দশটি করে। অঞ্চলের অফিস থেকেই ট্রেড লাইসেন্স-এর জন্য আবেদন ফর্ম পাওয়া যাবে এবং সেখান থেকেই চূড়ান্তভাবে ট্রেড লাইসেন্সটি প্রদান করা হবে।

ট্রেড লাইসেন্স না করার সাজা

স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এর ৯২ ধারায় বলা হয়েছে পঞ্চম তফসিল অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তি অপরাধ করে থাকে তবে তাকে সাজা পেতে হবে, এদিকে পঞ্চম তফসিলে ট্রেড লাইসেন্স না করা, রিনিউ না করা ও কর ফাঁকি দেওয়াকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়োছে। তাই ট্রেড লাইসেন না করা, রিনিউ না করা ও কর ফাঁকি দেওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। 

স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এর ধারা ৯৩ অনুসারে কোন ব্যক্তি ট্রেড লাইসেন্স না নিলে/রিনিউ না করে ব্যবসায় পরিচালনা করলে৷ তাকে প্রথমবার/প্রথম দিনের জন্য ৫০০০ টাকার জরিমানা করতে পারে এবং পরবর্তী প্রতিবার/প্রতিদিনের জন্য ৫০০ টাকা করে জরিমানা করতে পারে। এই জরিমানা থেকে বাঁচতে ট্রেড লাইসেন্স করতে হবে। আর জরিমানা প্রদান না করলে তার নামে মামলা হতে পারে। 

আবার, যদি কেউ ট্রেড লাইসেন্স না করে ব্যবসা পরিচালনা করে বা নিজেকে ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেয় সেটা প্রতারণার সামিল হবে এবং তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা হতে পারে, তাছাড়াও অন্য দেওয়ানী বা ফৌজদারি মামলাও হতে পারে।

ট্রেড লাইসেন্স-এর জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র  

ব্যবসার ধরনের উপর ভিত্তি করে ট্রেড লাইসেন্স-এর জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রেও ভিন্নতা আসে।  

স্বত্বাধিকারী ব্যবসার ক্ষেত্রে :

  • ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অফিস বা দোকান ভাড়ার চুক্তিপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি  অফিস বা দোকান ব্যবসায়ির নিজের জায়গা হলে ইউটিলিটি বিল এবং হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের ফটোকপি। এই অফিস বা দোকানটি অবশ্যই বাণিজ্যিক স্থাপনায় হতে হবে। সাধারণত কোন এলাকায় ভবন দুইভাবে নির্মিত হয়- এক. আবাসিক ও দুই. বাণিজ্যিক। যে কোন ধরনের ব্যবসার অফিস অবশ্যই বাণিজ্যিক ভবনে নিতে হবে, নতুবা ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করা হয় না।  
  • স্বত্বাধিকারীর তিন কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি  
  • স্বত্বাধিকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র  

অংশীদারী ব্যবসার ক্ষেত্রে :

  • অফিস বা দোকান ভাড়ার চুক্তিপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি  জায়গাটি অংশীদারদের কারোর নিজের হলে ইউটিলিটি বিল এবং হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের ফটোকপি।  
  • ৩০০ টাকার দলিলে অংশীদারী ব্যবসার চুক্তিপত্র  
  • ম্যানেজিং পার্টনারের তিন কপি ছবি  
  • ম্যানেজিং পার্টনারের জাতীয় পরিচয়পত্র  

কোম্পানির ক্ষেত্রে  

  • অফিস বা দোকান ভাড়ার চুক্তিপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি  জায়গাটি অংশীদারদের কারোর নিজের হলে ইউটিলিটি বিল এবং হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের ফটোকপি।  
  • কোম্পানির সার্টিফিকেট অফ ইন-কর্পোরেশন 
  • কোম্পানির মেমরেন্ডাম ও আর্টিকেল অফ এসোসিয়েশন  
  • ম্যানেজিং ডিরেক্টরের তিন কপি ছবি  
  • ম্যানেজিং ডিরেক্টরের জাতীয় পরিচয়পত্র  

ট্রেড লাইসেন্স করতে প্রয়োজনীয় খরচ ও সময়  

ব্যবসার ধরনের উপর ভিত্তি করে যেভাবে লাইসেন্স পরিবর্তিত হয় ঠিক সেভাবেই বিভিন্ন ব্যবসার লাইসেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় খরচের মধ্যেও বেশ তারতাম্য ঘটে। লাইসেন্স ফি ব্যবসার ধরনের ওপর নির্ভর করে কমবেশি হতে পারে। এই ফি সংশ্লিষ্ট অফিসে রসিদের মাধ্যমে জমা দিতে হবে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে এই অঙ্কটি নিম্নে এক থেকে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এক নামে একাধিক ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যবসার ধরণ অনুযায়ী খরচ আরও বৃদ্ধি পাবে। তবে কোম্পানির ক্ষেত্রে সকল ধরনের ব্যবসা এক লাইসেন্স দিয়ে স্বল্প খরচে করা যাবে। 

সিটি কর্পোরেশন আদর্শ কর তফসিল, ২০১৬-এর বিধিমালা অনুযায়ী ট্রেড লাইসেন্সের এই খরচ-এর হার সমূহ নির্ধারণ করা হয়।  এছাড়া এর সাথে আকৃতি অনুসারে সাইনবোর্ড ফি, লাইসেন্স বই-এর খরচ ও এগুলোর উপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট-এর খরচ আছে।  ট্রেড লাইসেন্স-এর আনুষঙ্গিক খরচাদি আবেদন ফরমে উল্লেখিত ব্যাংক সমূহে জমা দেয়ার মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।  

সাধারণত, একটি লাইসেন্স পেতে তিন থেকে সাত কর্ম দিবস সময় লাগতে পারে।

ধাপে ধাপে ট্রেড লাইসেন্স করার পদ্ধতি  

ধাপ-১: সর্বপ্রথম কাজ হচ্ছে ব্যবসায়িক কেন্দ্রের জন্য সঠিক অঞ্চল নির্ধারণ করা।  

ধাপ-২: আই ফরম ও কে ফরম নামে ট্রেড লাইসেন্স আবেদনের দুটি ভিন্ন ধরনের ফরম (form) আছে। ছোট কিংবা সাধারণ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য আই ফরম এবং বড় ব্যবসার ক্ষেত্রে কে ফরম সংগ্রহ করতে হয়। প্রতিষ্ঠানটি যে অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত সেই অঞ্চলের অফিস থেকেই এই ফরমগুলো সংগ্রহ করা যাবে, যেগুলোর প্রতিটির দাম ১০ টাকা।  

ধাপ-৩: সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে ট্রেড লাইসেন্স-এর ফি ভ্যাটসহ জমা দিয়ে রশিদ সংগ্রহ করতে হবে।  

ধাপ-৪: ব্যবসার ধরন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন ফর্মটির সাথে ব্যাংকে ফি জমা রশিদটি সংযুক্ত করে স্থানীয় সরকারের অফিসে জমা দিতে হবে।  

ধাপ-৫: স্থানীয় সরকারের অধীভূক্ত আঞ্চলিক অফিস থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা ব্যবসায়িক কেন্দ্রটি পরিদর্শন করে অফিসে রিপোর্ট করবেন।  

ধাপ-৬: পূর্ববর্তী প্রতিটি ধাপ সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে এই চূড়ান্ত পর্যায়ে ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া যাবে সেই আঞ্চলিক অফিস থেকে।  ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন  প্রতিটি নতুন ট্রেড লাইসেন্স-এর মেয়াদ থাকে এক বছর। স্বভাবতই ট্রেড লাইসেন্স এর কার্যকারিতা বহাল রাখতে হলে প্রতি বছরই ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়।  

ট্রেড লাইসেন্স নতুন করার সময় যে সরকারি ফিগুলো প্রদান করা হয় তা হলো, ট্রেড লাইসেন্স ফি, সাইন বোর্ড ফি এবং এই দুটো মিলে যত টাকা হয় তার উপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট। আর ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের সময় এই খরচগুলোর সাথে যোগ হয় উৎসকর, যেটি সিটি করপারেশনের ক্ষেত্রে ৩,০০০ টাকা। ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার ক্ষেত্রে এটি কিছুটা কম হয়।  

ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন

লাইসেন্স নবায়ন একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। একটি লাইসেন্সের মেয়াদ এক বছর এবং এর মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে আবেদন করতে হবে। এ জন্য,
১। পূর্বের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত আঞ্চলিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
২। দায়িত্বপ্রাপ্ত আঞ্চলিক কর বিষয়ক কর্মকর্তা নবায়নকৃত ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করবেন।
৩।  লাইসেন্স নবায়নফি নতুন লাইসেন্সের সমপরিমাণ। এই ফি আগের মতোই লাইসেন্স ফরমে উল্লিখিত ব্যাংকে প্রদান করতে হয়।

প্রতি বছর জুন-জুলাইয়ে সাধারণত ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। একসঙ্গে একাধিক বছরের ফি জমা দিয়েও একাধিক বছরের জন্য ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করার সুযোগ আছে।

লাইসেন্স বাতিল 

মিথ্যা বা অসম্পূর্ণ তথ্য দিলে, লাইসেন্সে উল্লিখিত শর্তাবলি এবং সিটি করপোরেশনের আইন ও বিধি মেনে না চললে লাইসেন্স বাতিল হতে পারে। এ ছাড়া লাইসেন্স গ্রহীতার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। তবে যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগে গ্রহীতাকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিতে হয়।

ব্যবসাকে বৈধকরণের জন্য ট্রেড লাইসেন্স একটি অপরিহার্য সনদ। ট্রেড লাইসেন্স দেয়া এবং এর নবায়ন স্থানীয় সরকারের কর আদায়ের একটি মাধ্যম। এটি ছাড়া যে কোন ব্যবসা প্রতারণার সামিল হবে। এ অপরাধে এমনকি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রতারণার হিসেবে দেওয়ানী বা ফৌজদারি মামলাও হতে পারে। তাই সঠিক ও বৈধ ভাবে ব্যবসা পরিচালনায় ট্রেড লাইসেন্স-এর কোন বিকল্প নেই। 


Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *