Property law in Bangladesh

সম্পত্তি বণ্টনের মামলা করবেন কিভাবে?

সম্পত্তি বণ্টনের মামলা করবেন কিভাবে?

সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে বিবাদ-বিসংবাদ একটি সনাতন ব্যাপার। উত্তরাধিকার সম্পত্তি কিংবা যৌথ সম্পত্তিতে সহ-অংশীদারদের মালিকানা নির্ণয়ে নানা রকম আইনি জটিলতা ও বিরোধ সৃষ্টি হয়। বাটোয়ারা দলিলের মধ্য দিয়ে অংশীদাররা শুরুতে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে ঐকমত্যে পৌঁছা সম্ভব না হলে আদালতে ‘বাটোয়ারা মামলা’ দায়ের করার বিকল্প থাকে না।

দৃশ্যপট-১
ফারহানারা তিন ভাই ও চার বোন। মা বেঁচে আছেন। তার বাবার মৃত্যুর সময় প্রায় ৩০ কোটি টাকার সম্পদ ও সম্পত্তি রেখে গেছেন ওয়ারিশদের জন্য। কিন্তু সম্পত্তি এখন পর্যন্ত ভাগ হয়নি। ফারহানার দুই ভাই জোর করে বেশি সম্পত্তি ভোগ করছেন। আবার তার এক ভগ্নিপতি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেও বেশ কিছু সম্পত্তি ভোগ করছেন। এর মধ্য দিয়ে বিপদে আছে ফারহানা, তার মা আর তিন বোন। তার দুই ভাই ও ছোট ভগ্নিপতি সম্পত্তি ভাগ করতে দিতে চান না।

এত এত সম্পত্তি থাকার পরও ফারহানারা মারাত্মক কষ্টে দিনাতিপাত করছে। এতদিন যাবত সম্পত্তির দলিলপত্র ফারহানার মায়ের কাছে ছিল। কিন্তু কিছুদিন আগে তার ভাইয়ের ছেলে ও ছোট ভগ্নিপতি সম্পত্তির সব দলিল ফারহানার বুকে ছুরি ঠেকিয়ে লকার ভেঙে নিয়ে গেছে। যখনই তাদের পক্ষ থেকে সম্পত্তি ভাগ করতে চাওয়া হয়, তখনই তার দুই ভাই ও ছোট ভগ্নিপতি তাদের ভয়-ভীতি দেখায়। মা আর তিন বোন নিয়ে ফারহানা বেশ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। 

 দৃশ্যপট-২

সাদিয়ারা পাঁচ ভাই বোন। দুই ভাই তিন বোন। তার বাবা মৃত্যুর সময় প্রায় ১০০ বিঘা সম্পত্তি রেখে গেছেন। কিন্তু সেই সম্পত্তির কোনো অংশেই সাদিয়াদের তিন বোনের কোনো অংশ দেয়া হয়নি। দুই ভাই জবরদস্তিমূলকভাবে সকল জমি নিজেদের খেয়ালখুশিমতো ভোগদখল করে আসছে। সাদিয়ারা সম্পত্তিতে অংশ চাইলে ভাইয়েরা তাদের সঙ্গে প্রচ- প্রতিক্রিয়া দেখায়। সাদিয়াদের বিয়ের সময় প্রচুর অর্থ খরচ হয়েছে বলে তাদের কোনো সম্পত্তি দেয়া হবে না বলে জানিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে বহু চাপাচাপির পর ভাইয়েরা একটি বাটোয়ারা দলিল করে বোনদের নামমাত্র কিছু সম্পত্তি দিয়ে বিষয়টির সুরাহা করতে চায়। কিন্তু সাদিয়ারা সেই বণ্টনে সম্মতি দেয় না। 

এখন সাদিয়ারা কী করতে পারে? বাংলাদেশের শহরে-গ্রামে উত্তরাধিকার সম্পত্তি নিয়ে এরকম বিবাদ-বিসংবাদ অহরহ ঘটে থাকে। এ ধরনের ক্ষেত্রে সম্পত্তির বৈধ হকদার আইন অনুযায়ী ওয়ারিশ সার্টিফিকেট দাখিল করে সম্পত্তির অংশ বুঝে পাওয়ার জন্য দেওয়ানি আদালতে ‘বাটোয়ারা মামলা’ দায়ের করতে পারেন। বাটোয়ারা মামলায় বিজ্ঞ আদালত ইসলামি শরিয়া ও ফারায়েজ আইন অনুযায়ী সম্পত্তি বণ্টন করে দেন।

বাটোয়ারা মামলা’ কী?

ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তির সীমানা চিহ্নিত করে যার যার প্রাপ্ত স্বত্ব বুঝে নেয়ার প্রক্রিয়াটি হচ্ছে ‘বণ্টন’। স্থানীয় বা পারিবারিকভাবে বণ্টনের আইনগত ভিত্তি তুলনামূলকভাবে দুর্বল। আদালতের মাধ্যমে উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টন করে নিলে জটিলতা অনেক কমে। এ জন্য সব শরিককে এখতিয়ারসম্পন্ন দেওয়ানি আদালতে একটি মামলা করতে হয় যা ‘বণ্টন মোকদ্দমা’ বা ‘বাটোয়ারা মামলা’ নামে পরিচিত। ইংরেজিতে একে ‘পার্টিশন স্যুট’ বলা হয়। সম্পত্তির শরিক দুই ধরনের_ উত্তরাধিকার সূত্রে শরিক বা কো-শেয়ারার বাই ইনহেরিটেন্স এবং খরিদ সূত্রে শরিক বা কো-শেয়ারার বাই পারচেজ। বাটোয়ারা মামলা করার সময় সকল অংশীদারকে মামলায় পক্ষভুক্ত হতে হবে। কোনো একজন শরিক বাদ থাকলে বণ্টননামা শুদ্ধ হবে না।

 

যদি অংশীদাররা আপস মতে বণ্টন করতে রাজি না হন, সে ক্ষেত্রে যে কোনো অংশীদার বণ্টনের জন্য আদালতে মামলা করতে পারেন। বাটোয়ারা মামলায় কী কী প্রয়োজন? প্রথমেই আপনাকে একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর শরণাপন্ন হতে হবে। পাশাপাশি সম্পত্তির মালিকানা সংশ্লিষ্ট সব কাগজপত্র যেমন ভূমি জরিপ খতিয়ান, নামজারি খতিয়ান, মালিকানা দলিল, উত্তরাধিকার সনদ ইত্যাদি সংগ্রহে রাখতে হবে।

 মামলা করার জন্য কোর্ট ফি দিতে হয় ১০০ টাকা কিন্তু ছাহাম চাইলে প্রতি ছাহামের জন্য অতিরিক্ত ১০০ ফি জমা দিতে হয়। বণ্টনের শর্তাবলি বণ্টনের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত জড়িত। যেমন_ সম্পত্তি পরিমাপ করে অংশীদারদের জমির সীমানা চিহ্নিত করতে হবে এবং বণ্টন তালিকায় প্রত্যেক সহ-মালিকের বরাদ্দকৃত সম্পত্তির উল্লেখ থাকতে হবে; তালিকায় মালিকানার বিভাজন সকল সহ-মালিক কর্তৃক স্বীকৃত হতে হবে; বণ্টনের বিবরণ সুস্পষ্ট হতে হবে; প্রত্যেকটি তালিকা সহ-মালিকদের কাছ থেকে স্বাক্ষরিত হতে হবে; যথাযথভাবে স্ট্যাম্প শুল্ক দিয়ে দলিলটি রেজিস্ট্রি করতে হবে; সহ-অংশীদাররা আপস বণ্টন করে পরবর্তীতে তাদের কেউ তা না মানলে দেওয়ানি আদালতের মাধ্যমে তা কার্যকর করা যায়। বাটোয়ারা মামলায় সাধারণত প্রত্যেক দাগের জমি সব সহ-শরিকের মধ্যে বণ্টিত হয়ে থাকে। 

এ ধরনের মামলায় দুইবার দুটি ডিক্রি হয়, যার প্রথমটির নাম প্রাথমিক ডিক্রি আর পরেরটার নাম চূড়ান্ত ডিক্রি। প্রাথমিক ডিক্রিতে হিস্যা অনুযায়ী বণ্টনের আদেশ দেয়া হয়।

আর চূড়ান্ত ডিক্রিতে প্রয়োজনে আমিন কমিশন পাঠিয়ে সরেজমিনে সম্পত্তির দখল দেয়া হয় এবং সীমানা পিলার দ্বারা বিভাজন (জমির ভাগ) করার মাধ্যমে চূড়ান্ত ডিক্রি প্রচার করা হয়। আদালত প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োগ করে সম্পত্তির সীমানা চিহ্নিত করে ডিক্রিপ্রাপককে সম্পত্তির দখল দেয়ার ব্যবস্থা করে থাকেন। বণ্টন হওয়ার পর করণীয় আদালতের মাধ্যমে বণ্টন হওয়ার পর এবং বণ্টন দলিল রেজিস্ট্রি করার পর অবশ্যই নিজ নামে নামজারি, জমাভাগ খতিয়ান করে নিতে হবে।

পাশাপাশি খাজনাও প্রদান করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নামজারি হচ্ছে সরকারিভাবে সম্পত্তিকে নিজ নামে রেকর্ড করা। বণ্টনের পরও দখল না পেলে আদালত থেকে বাটোয়ারা মামলার ডিক্রি পাওয়ার পরও সেই মোতাবেক দখল বুঝিয়ে দেয়া না হলে ‘উচ্ছেদের মামলা’ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে অংশীদারদের ভয়-ভীতি ও হুমকি দেয়া হলে সংশ্লিষ্ট ও নিকটস্থ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা যেতে পারে। ভয়-ভীতি-হুমকি ও জীবননাশের আশঙ্কায় আদালতে ফৌজদারি মামলাও করা যায়।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *