হেবা/জমি বিক্রয় দলিল সৃজন, নিবন্ধন

হেবা/জমি বিক্রয় দলিল সৃজন, নিবন্ধন

হেবা; জমি বিক্রয়; দলিল সৃজন; নিবন্ধন: 

হেবা: হেবা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো অন্যের প্রতি অনুগ্রহ করা। এর সাধারণ অর্থ দান। কোন মূল্য ব্যতীত স্বেচ্ছায় অন্যকে সম্পত্তির মালিক বানিয়ে দেয়াই হচ্ছে হেবা। হেবা সুস্পষ্ট ও সুউচ্চারিত হতে হবে। সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১২২ ধারা অনুযায়ী স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তির বরাবরে বিনাপণে কোন স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করাকেই দান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। 

সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ঐ ধারা অনুযায়ী দান লিখিত, সাক্ষী দ্বারা সমর্থিত এবং রেজিস্ট্রীকৃত হতে হবে। এখানে দখল প্রমাণের বিষয়টি এতটা প্রাধান্য পায় না। কিন্তু সম্পত্তি হস্তান্তর আইন হেবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। দান বা হেবায় তিনটি উপাদান অবশ্যই থাকতে হবে, তা হলো- 

(১) দাতা কর্তৃক দখল করার প্রস্তাব; 

(২) গ্রহীতা কর্তৃক তা গ্রহণের সম্মতি; ও

(৩) দানকৃত সম্পত্তির দখল বুঝে নেওয়া।

প্রকারভেদ

মুসলমানদের মধ্যে দান দুই ধরনের হয়ে থাকে, যথা: 

(১) হেবা বা সাধারণ দান; 

(২) হেবা-বিল-এওয়াজ বা কোন কিছুর বদলে দান; এবং  

 

হেবা/সাধারণ দান: সাধারণভাবে হেবা বলতে শর্তবিহীনভাবে ও স্বেচ্ছাপ্রনোদিত হয়ে বিনিময়মূল্য ছাড়া এক ব্যক্তি কতৃক অন্য ব্যক্তিকে কোন সম্পত্তির হস্তান্তর বোঝায়।

 

হেবা-বিল-এওয়াজ: হেবা-বিল-এওয়াজের শাব্দিক অর্থই হলো প্রতিদানের জন্য দান। অর্থাৎ এই প্রকারের দানের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রতিদান থাকতে হবে। হেবা বা সাধারণ দানের সাথে হেবা-বিল-এওয়াজের পার্থক্য এই যে, হেবা-বিল-এওয়াজ হলো প্রতিদানের জন্য প্রদত্ত একটি দানবিশেষ। বস্তুত এটি এক প্রকারের বিক্রয় এবং এতে বিক্রয়-চুক্তির যাবতীয় শর্ত বিদ্যমান থাকে।

 

জমি বিক্রয়:

জমি ক্রয়ের পূর্বে ও পরে করণীয়:

জমি ক্রয় কালে ক্রেতাদেরকে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে তা তুলে ধরা হলোঃ

 

১। জরিপের মাধ্যমে প্রণীত রেকর্ড অর্থাৎ খতিয়ান ও নকশা যাচাই করতে হবে।

 

২। জমির তফসিল অর্থাৎ জমির মৌজা, খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর উক্ত দাগে জমির মোট পরিমাণ জানতে হবে।

 

৩। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সিএস, এসএ, আরএস, বিএস পর্চা দেখতে হবে।

 

৪। বিক্রেতা ক্রয়সূত্রে ভূমির মালিক হয়ে থাকলে তার ক্রয় দলিল বা ভায়া দলিল রেকর্ডের সঙ্গে মিল করে বিক্রেতার মালিকানা নিশ্চিত হতে হবে।

 

৫। বিক্রেতা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হলে সর্বশেষ জরিপের খতিয়ান বিক্রেতা বা তিনি যার মাধ্যমে প্রাপ্ত তার নামে অস্তিত্ব (যোগসূত্র) মিলিয়ে দেখতে হবে।

 

৬। জরিপ চলমান এলাকায় বিক্রেতার কাছে রক্ষিত মাঠ পর্চা যাচাই করে দেখতে হবে।

 

৭। বিক্রেতার কাছ থেকে সংগৃহীত দলিল সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিস/জেলা রেজিস্ট্রার রেকর্ড রুম হতে যাচাই করে দেখতে হবে।

 

৮। খতিয়ান/পর্চা/মৌজা ম্যাপ ইত্যাদি কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি অফিস/উপজেলা ভূমি অফিস/জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুম হতে যাচাই করে দেখতে হবে।

 

৯। হাল সন পর্যন্ত ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) পরিশোধ আছে কি না দেখতে হবে।

 

১০। প্রস্তাবিত সম্পত্তির দখল বিক্রেতার আছে কি না। সম্পত্তিতে বিক্রেতার দখল না থাকলে সে জমি ক্রয় করা উচিত হবে না।

 

১১। ওয়ারিশি জমি কিনতে চাইলে, ঐ সম্পত্তিতে মোট কতজন ওয়ারিশ আছে তা খোজ নিয়ে দেখুন। আপনি যে ওয়ারিশের নিকট থেকে কিনবেন, তার ততটুকু বিক্রয়ের অধিকার আছে কিনা যাচাই করুন।

 

১২। সম্পত্তিটি খাস কিংবা সরকারী কিনা যাচাই করুন। সরকারী বা খাস সম্পত্তি বিধিবহির্ভূত ভাবে ক্রয়-বিক্রয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

 

১৩। অন্য কোন পক্ষের সাথে বিক্রয় চুক্তি বা বায়না পত্র রেজিস্ট্রি করা আছে কি না তা যাচাই করুন।

 

১৪। ব্যাংক বা কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিকট দায়বদ্ধ কি না তা যাচাই করুন।

 

১৫। জমি বিক্রয়ের জন্য অ্যাটর্নি নিয়োগ করা আছে কিনা তা যাচাই করুন। অ্যাটর্নি নিয়োগ করা থাকলে অ্যাটর্নি ছাড়া মূল মালিকের সম্পাদন গ্রহণযোগ্য নয়।

 

১৬। জমি নিয়ে মামলা মোকদ্দমা চলছে কিনা যাচাই করুন। মামলাভুক্ত জমি কেনা উচিত নয়।

 

জমি ক্রয়ের পরে ক্রেতা বা মালিকের করণীয়:

 

১। জমি রেজিস্ট্রি করার পর ক্রয়কৃত জমির দখল, সীমানা নির্ধারণ এবং জমি ব্যবহার তথা চাষাবাদ বা বাড়ীঘর নির্মাণ করা।

 

২। রেজিস্ট্রি অফিস হতে মূল দলিল গ্রহন করা। মূল দলিল প্রাপ্তিতে বিলম্ব হলে দলিলের সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করা।

 

৩। মিউটেশন/নামজারী করার জন্য সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর অফিসে দলিলের সত্যায়িত কপিসহ নির্ধারিত ফরমে আবেদন করে মিউটেশন/নামজারী করানোর ব্যবস্থা করা।

 

৪। নিয়মিত ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা, ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ না করা হলে জমি নিলাম হয়ে যেতে পারে।

 

৫। ভালোভাবে জমির সীমানা চিহ্নিত করে না রাখলে অন্যেরা অনধিকার প্রবেশ করার সুযোগ পাবে।

 

বাংলাদেশের প্রায় ৭০% লোক কোন না কোনভাবে ভূমির উপর নির্ভরশীল। এদেশে ভূমি একটি বেশ সংবেদনশীল ও স্থিতিশীল সেক্টর। বিভিন্ন কারণে ভূমি বিরোধ সৃষ্টি হয়, প্রধান কারণগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য (ক) যৌথ পরিবারের মধ্যে ভাগবণ্টন সংক্রান্তে বিরোধ (খ) ক্রয়কৃত জমির প্রকৃত মালিকানা সংক্রান্তে জটিলতা (গ) ক্রয়কৃত জমির দলিল সঠিকভাবে রেজিষ্ট্রি না করা (ঘ) ভূমি অফিসের রেকর্ড সংগ্রহে জটিলতা/ক্রুটি (ঙ) পৈত্রিক সম্পত্তি বন্টনে স্বচ্ছতার অভাব (চ) যৌথ পরিবারে বিশেষভাবে মেয়ে সন্তানদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির যথাযথবণ্টন না করা ইত্যাদি।  

 

জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধ সমূহ দেওয়ানী আদালতে নিস্পত্তি যোগ্য। দেওয়ানী আদালতে বিচার কার্য্য সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয় যার ফলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিবর্গ নিজেরা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জমির দখল নিতে সচেষ্ট হন। ফলশ্রুতিতে জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে এলাকায় দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ শান্তি ভঙ্গের আশংকা দেখা দেয়। দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রায় ৬০% ফৌজদারী মামলা ভূমি সংক্রান্ত ঘটনা বা ঘটনার জের হিসাবে হয়ে থাকে। সুতরাং জমির ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সকলের অধিক যত্ববান ও সর্তক হওয়া উচিত।



দলিল সৃজন, নিবন্ধন: ফ্ল্যাট কিংবা জমি নিজে ক্রয় করতে গেলেই সম্পত্তি ক্রয়ের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জেনে নেওয়া উচিত। কী কী করতে হবে, কোথায় কোথায় যেতে হবে এই সমস্ত বিষয় সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থাকাটা বেশ জরুরী। যেমন, জমির মালিকানা যাচাই, সকল নথিপত্র তৈরি করা, সমস্ত নথি বা দলিলপত্রের সত্যতা যাচাই করা, রেজিস্ট্রেশনের জন্য সকল দলিলপত্র জমা দেওয়া এবং সবশেষে সেগুলো রেজিস্ট্রেশন অফিস থেকে সংগ্রহ করা। তবে এই প্রক্রিয়াটির মধ্যে আপনাকে খুব সচেতন হতে হবে অন্যথায়, আপনি জালিয়াতির শিকার হতে পারেন এবং সম্পত্তি হারাতেও পারেন। সুতরাং ফ্ল্যাট কিংবা জমি কেনার আগে অবশ্যই আপনাকে বাংলাদেশে সম্পত্তি রেজিস্ট্রির পুরো প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জানতে হবে এবং এটি কীভাবে সম্পন্ন করা হয় সে সম্বন্ধেও জানতে হবে যাতে করে আপনাকে কোন দূর্ঘটনার মুখে যেন পড়তে না হয়।

২০০৫ সালের ১ জুলাই থেকে জমির যেকোনো হস্তান্তরযোগ্য দলিল রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী, যে দলিল রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক অথচ রেজিস্ট্রেশন করা হয়নি, তখন সেই দলিল নিয়ে আপনি কোনো দাবি করতে পারবেন না। আইন অনুযায়ী দলিল রেজিস্ট্রি করা হলে মালিকানা নিয়ে বিরোধ এড়ানো যায়। এছাড়া জমি রেজিস্ট্রি করা থাকলে পরবর্তীতে বিক্রি, দান, উইল করতে সহজ হয়। স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় দলিল অবশ্যই লিখিত হতে হবে। দলিলের বিষয়বস্তু যে এলাকার এখতিয়ারের মধ্যে রয়েছে, সেই এলাকার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল রেজিস্ট্রি করতে হবে।

বিস্তারিত জানতে আইনিসেবার ব্লগে ভিজিট করুন। 

জমি-জমা সংক্রান্ত যেকোনো পরামর্শের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।